* চার লেনের প্রকল্পের কাজে ধীরগতি * সড়কেই পচে যাচ্ছে শিল্পকারখানার কাঁচামাল * সময়মতো পৌঁছানো যাচ্ছে না রফতানি পণ্য * বেড়েছে পরিবহন ব্যয়, ভোগান্তি চরমে * ভাঙা সড়কে প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে যানবাহনের যন্ত্রাংশ
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অংশ। এই মহাসড়কের আশুগঞ্জ থেকে সরাইল পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। আগে যে পথ চার-পাঁচ ঘণ্টায় পাড়ি দেওয়া যেত যানজটের কারণে এখন সেখানে লাগছে প্রায় ২৪ ঘণ্টা। এতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। সঠিক সময়ে পণ্য না পৌঁছানোয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে বৃষ্টি হলে প্রকট আকার ধারণ করে যানজট। সড়কের খানাখন্দে পড়ে নষ্ট হচ্ছে যানবাহন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ‘নরক’ যন্ত্রণায় ভোগেন যানবাহনের পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীরা।
সড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, ভারত ও বাংলাদেশের আন্তঃবাণিজ্য গতিশীল করার লক্ষ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড় হয়ে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১৫ সালে একনেকে এই প্রকল্প অনুমোদন পায়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। পরে ২০১৭ সালে কাজটি শুরু করে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
তিনটি প্যাকেজে (আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের খাটিহাতা মোড় পর্যন্ত প্যাকেজ-১, খাটিহাতা মোড় থেকে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের তন্তর পর্যন্ত প্যাকেজ-২ এবং তন্তর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত প্যাকেজ-৩) ভাগ করে এই চার লেন মহাসড়কের কাজ শুরু করা হয়। তবে প্যাকেজ-১ ও প্যাকেজ-২ এর কাজ প্রকল্প চালুর পরপর শুরু করা গেলেও জমি অধিগ্রহণসহ নানান জটিলতায় প্যাকেজ-৩ এর কাজ এগিয়ে নেওয়া যায়নি। এরমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার প্যাকেজ-৩ এর কাজ ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে।
গত রোববার সরেজমিনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের বেড়তলা থেকে খাঁটিহাতা মোড় পর্যন্ত পরিদর্শনে দেখা যায়, ছোটবড় অর্ধশতাধিক গর্ত। এসব গর্তের খানাখন্দ ভরাটের কাজ করছেন শ্রমিকরা। খাঁটিহাতা বিশ্বরোড মোড়ে খানাখন্দের রাস্তা মেশিন দিয়ে উপড়ে ফেলা হচ্ছে। পরে রোলার করে সমান করা হচ্ছে। এর ওপর ইট বিছানো হচ্ছে। খাঁটিহাতা বিশ্বরোড গোল চত্বর অংশে ১২ মিটার প্রস্থ ও ১৮৫ মিটার দৈর্ঘ্য, আর গোল চত্বর থেকে সিলেটমুখী সরাইল কুট্টাপাড়া খেলার মাঠ পর্যন্ত ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থে তিন স্তরে ইট ও বালু বিছানো হচ্ছে। এরই মধ্যে সন্ধ্যায় বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টিতে খানাখন্দে পানি জমে মহাসড়ক বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়। লেগে যায় সড়কের উভয় পাশে দীর্ঘ যানজট। গাড়ি চলে ধীরগতিতে।
তবে যানবাহন চালকরা বলেন, সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এই সড়ক পরিদর্শনে আসতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। তাই দ্রুত জোড়া তালি দিয়ে মেরামত করা হচ্ছে। কিন্তু এগুলো টিকবে না।
এই মহাসড়ক দিয়ে পণ্য পরিবহনে ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যানবাহনগুলো। আয় থেকে ব্যয় বাড়ছে বলে জানিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। সঠিক সময়ে মালামাল কারখানায় না পৌঁছানোয় ব্যাহত হচ্ছে কলকারখানার উৎপাদন। বিশেষ করে এই মহাসড়ক দিয়ে হবিগঞ্জে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালামাল পরিবহন করা হয়। পাঁচ ঘণ্টার পথে যানজট পাড়ি দিতে সময় লাগছে ২৪ ঘণ্টার বেশি। ফলে গাড়িতে থাকা কাঁচামাল পচে নষ্ট হচ্ছে। বাতিল হচ্ছে পণ্য রফতানির শিপমেন্ট। এনিয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন শিল্পপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা।
হবিগঞ্জের যমুনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (ইঞ্জিনিয়ারিং) আবুল হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এই পথ হয়ে গাড়ি আসে, ঢাকা থেকে সিমেন্ট ও রড আসে। আগে তিন ঘণ্টা সময় লাগতো, এখন আট ঘণ্টায়ও আসতে পারছে না। আমাদের উৎপাদনে যেসব মালামাল চট্টগ্রাম থেকে আসছে, তারাও এই সড়কে পণ্য পরিবহনে সমস্যার কথা জানিয়েছেন। বায়াররাও এই সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে পরিদর্শনে আসতে পারছেন না। শুধু ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দীর্ঘ যানজট ও বেহাল অবস্থার কারণে আমাদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
হবিগঞ্জ প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের চিফ প্ল্যান্ট অফিসার দীপক কুমার দেব বলেন, ঢাকা থেকে হবিগঞ্জে পণ্য পরিবহন করা যেত চার-পাঁচ ঘণ্টায়। কিন্তু মহাসড়কের বেহাল অবস্থা ও যানজটের কারণে এখন লাগছে ১০-১২ ঘণ্টা। আমরা যেহেতু পণ্য রফতানি করি, তা অনেক সময় পিছিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরে সঠিক সময়ে না পৌঁছানোর কারণে। এতে পণ্য পরিবহনে আমাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আমরা পচনশীল পণ্য উৎপাদন করি। এক্ষেত্রে কিছু পণ্যের কাঁচামাল ৬-৭ ঘণ্টা পর ফ্রিজিং করতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, এসব পণ্য পরিবহনে রাস্তায়ই ১২-১৩ ঘণ্টা লেগে যায়, ফলে এগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সড়কে খানাখন্দের কারণে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। পণ্য পরিবহনেও বেড়েছে অনেক খরচ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সার আমদানিকারক মেসার্স আবুল ট্রেডার্সের মালিক আমীর হোসেন বলেন, আমরা গাজীপুর থেকে সার এনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিক্রি করি। আশুগঞ্জ থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত সড়কে খানাখন্দ ও যানজটের কারণে ট্রাকভাড়া প্রতি ট্রিপে অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। তারপরও সময়মতো সার এসে পৌঁছায় না। এতে দামের ওপর প্রভাব পড়ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কাজি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এই মহাসড়কের কারণে ব্যবসায়ীর ব্যবসা লাটে উঠেছে। সঠিক সময়ে পণ্য আমদানি করে ডেলিভারি দিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ঢাকা থেকে মালামাল সকালে পাঠালে বিকেলেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছে যাওয়ার কথা, কিন্তু দুদিনেও এসে পৌঁছায় না। সিলেট থেকেও মাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঢুকতে সমস্যা হচ্ছে। বিশ্বরোড মোড়ে এসে যানজটে আটকা পড়ছে। এসব বিষয় নিয়ে বহুবার আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হানিফ মিয়া বলেন, এই মহাসড়কের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। গত দু-তিন মাস ধরে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ঢাকা থেকে যদি বাস একবার ছেড়ে আসে, খাঁটিহাতা মোড় পার হতে হতে দিন শেষ। ফিরে আর যেতে পারছে না। এছাড়া বাসের যন্ত্রাংশ ভেঙে যাচ্ছে খানাখন্দে পড়ে। পরিবহন ব্যবসায়ীরা অধৈর্য হয়ে গেছেন, আর ক্ষতি সামলাতে পারছেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ট্রাক মিনিট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মেরাজ ইসলাম বলেন, ট্রাকের ব্যবসা একেবারে শেষ বললেই চলে। এই ভাঙা রাস্তার কারণে ট্রাকের এক্সেল ভেঙে পড়ে থাকছে। যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। ১০ হাজার টাকায় কোনো জায়গায় গেলে, সড়কেই ট্রাকের ক্ষতি হচ্ছে ৩০ হাজার টাকার। বিশেষ করে এই মহাসড়ক দিয়ে সিলেট থেকে পাথর, বালু ও পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে যেখানে দিনে আসা-যাওয়া করা যেত, তা দু-তিন দিন লেগে যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে পরিবহন ব্যয়ও। ট্রাক মালিকরাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকা বিমানবন্দর রোডে চলাচলকারী লাবিবা পরিবহনের দক্ষিণ পৈরতলার কাউন্টার ম্যানেজার আলাউদ্দিন লালন বলেন, আগে একেকটি গাড়ি প্রতিদিন ঢাকায় দুবার আপ-ডাউন করতে পারতো। এখন একবার ঢাকায় যেতেই কষ্ট হয়। প্রতিবার ঢাকায় গেলে সম্পূর্ণ আসন পূরণ হলে একটি গাড়ির লাভ হয় দুই হাজার টাকা। কিন্তু এখন কেউ বাসে আর যেতে চায় না, এতে গাড়ির আসনও পূর্ণ হয় না। শুধু ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যানজটের কারণে আমরা এ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অংশে খানাখন্দের কারণে প্রতিদিনই আশুগঞ্জ থেকে সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। বিশেষ করে বৃষ্টি হলে চার লেন প্রকল্পের প্যাকেজ-১ এর অংশ আশুগঞ্জ গোল চত্বর থেকে খাঁটিহাতা মোড় এলাকায় মহাসড়কে দেখা দেয় বিপর্যয়। সড়কের খানাখন্দে পানি জমে আরও খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। নষ্ট হয়ে যায় যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাক। ফলে যানজট এক-দুই দিনও স্থায়ী থাকে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের এ সমস্যার কারণে বেকায়দায় পড়েছে অন্যান্য যানবাহন। ব্যক্তিগত গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স যেতে পারছে না সঠিক সময়ে। হাসপাতালে সময় মতো না পৌঁছাতে পেরে সড়কে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর নিরাপত্তা ঝুঁকির অজুহাতে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের কর্মকর্তারা কাজ ফেলে দেশে ফিরে যান। ফলে অসমাপ্ত কাজে মহাসড়কে দেখা দেয় খানাখন্দ। বাড়ে দুর্ভোগ। চলে যাওয়ার তিন মাস পর ভারতীয় ঠিকাদারি কোম্পানির ৭০-৭৫ জন শ্রমিক বাংলাদেশে ফিরে এসে আবার কাজ শুরু করেন। কিন্তু কাজ শুরু করলেও গতি তেমন পায়নি, চলছে মন্থর গতিতে।
আশুগঞ্জ টু আখাউড়া স্থলবন্দর চার লেন প্রকল্পের ব্যবস্থাপক শামীম আহমেদ বলেন, আশুগঞ্জ থেকে খাঁটিহাতা মোড় পর্যন্ত মহাসড়কে আমাদের কিছুটা জটিলতা ছিল। মাঝে কিছুদিন কাজ বন্ধ ছিল। পরে ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। এখন সমস্যা সমাধান হয়েছে। দু-তিনদিনের মধ্যেই প্রকল্পের স্থায়ী কাজ শুরু হবে। আমাদের কাজ করতে কোনো বাধা নেই। আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পড়বে আশা করছি। তিনি বলেন, ভারতীয় অনেক শ্রমিক নিজ দেশে চলে গেছেন। তারা আগে প্রায় তিনশ জনের মতো ছিলেন। তাদের একটি অংশ ফিরে এসে এরইমধ্যে কাজে যোগদান করেছে। আশুগঞ্জ থেকে সরাইল অংশে পুরোদমে কাজ শুরু হলে আরও শ্রমিক এসে কাজে যোগ দেবেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক
দীর্ঘ যানজটে ক্ষতির মুখে ব্যবসা-বাণিজ্য
- আপলোড সময় : ০৮-১০-২০২৫ ১২:২৩:৩৪ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৮-১০-২০২৫ ১২:২৩:৩৪ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ